শেষ ছক্কা মেরেছিল বঙ্গোপোসাগর আম্ফানের
হাত ধরে। তৈরি হয়েছিল সুপার ঘূর্ণিঝড়। তারপর দীর্ঘ দুমাসের বেশি সময় যাবত আর সাগরে তৈরি হচ্ছেনা কোনো উল্লেখযোগ্য নিম্নচাপ। জুন জুলাইয়ে বঙ্গোপোসাগরে হাতে গোনা দুটি খুবই সাধারণ নিম্নচাপ তৈরি হয়। এবং দুটির জন্য বেশিরভাগ বৃষ্টি হয় ওড়িশা ও সংলগ্ন এলাকায়। সেই আম্ফানের পর থেকে বর্ষার সুষ্পষ্ট নিম্নচাপ বা গভীর নিম্নচাপের বৃষ্টিতে যে নাগাড়ে ধারাবর্ষণ চলে তার সাধ এখনো পায়নি কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গবাসী। অন্যদিকে গতবারের চেয়ে জুন জুলাই মাসে নিম্নচাপের সংখ্যা অনেক কম এবারে। এখন আমবাঙালির একটাই প্রশ্ন কেন এবারে ঠিকমতো বর্ষা ও নিম্নচাপের বৃষ্টি পাচ্ছিনা ??
ওয়েদার অফ ওয়েস্টবেঙ্গল জানায় ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের পর উল্লেখযোগ্য সিস্টেম না হওয়ার কারণ হল :
🛑 ঘূর্ণিঝড় আম্ফান ও নিসর্গের প্রভাবে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চলের আরবসাগর ও বঙ্গোপোসাগরে জলীয় বাষ্প পূর্ণ বাতাস ও লীনতাপ বেশ কিছুটা শোষণ হয়ে যায়। সাগরে বায়ুপ্রবাহের প্রকৃতির পরিবর্তনের ফলে নিম্নচাপের প্রবণতা হ্রাস পেয়েছে বেশ কিছুটা বঙ্গোপোসাগর ও সংলগ্ন এলাকায়।
🛑 বঙ্গোপসাগরে এম জে ও অর্থাৎ ম্যাডেন জুলিয়ান ওসিলেশন বর্তমানে ২ নম্বর ফেজে অ্যাম্প্লিচিউড ১ বা একের উপরে রয়েছে। জুন ও জুলাই মাসের পূর্ববর্তী সময়ে এম জে ও এর ক্রমান্বয়ে নানা ফেজে সরণের ফলে এবং অ্যাম্প্লিচিউড অনুকূল বেশিরভাগ ক্ষেত্রে না থাকার জন্য বঙ্গোপোসাগরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝা অন্যান্য বছরের তুলনায় কম পরিলক্ষিত হচ্ছে। অর্থাৎ অনুকূল এম জে ও না থাকায় বঙ্গোপোসাগরে সিস্টেম তেমন তৈরি হচ্ছিল না।
🛑 বঙ্গোপসাগরে উইণ্ড শেয়ার বর্তমানে যথেষ্ট বেশি রয়েছে। অর্থাৎ বায়ুমণ্ডলীয় শূন্যতার যায়গায় বঙ্গোপোসাগরের বেশিরভাগ অঞ্চলে
ভালোই বায়ুপ্রবাহের উপস্থিতি লক্ষ করা যাচ্ছে এর প্রভাবে উল্লেখযোগ্য নিম্নচাপ তৈরি যেমন হচ্ছে না। তার পাশাপাশি ঘূর্ণাবর্ত বা লঘুচাপ যেকটি হয়েছে সেগুলি সুসংগঠিত হতে পারেনি ও দুর্বল নিম্নচাপ হিসাবে দ্রুত স্থলভাগ অতিক্রম করেছে।
🛑 মধ্য ও পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপকে প্রভাবিত করে থাকে। মধ্য প্রশান্তে একটি উচ্চচাপ ছিল পূর্ববর্তী সময়ে। যার জন্য সুবৃহৎ অঞ্চলের বায়ুপ্রবাহ বেশি ছিল। উইণ্ড শেয়ার বেশি থাকায় দু মাসে উল্লেখযোগ্য টাইফুন বা গভীর নিম্নচাপ তৈরি হয়নি। ফলে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্রশান্ত মহাসাগর থেকে নিম্নচাপের পরিত্যক্ত অংশ আসতে পারেনি।
🛑 মৌসুমী অক্ষরেখা জুন জুলাই মাসের বেশিরভাগ সময় উপরে উঠে থাকায় ও বঙ্গোপোসাগর থেকে উত্তরভারতের দিকে খাড়া বায়ুর চাপঢাল তৈরি হওয়ার জন্য উত্তর বঙ্গোপসাগর ও তৎসংলগ্ন এলাকায় বায়ুর তীব্রতা বেশি থাকায় নিম্নচাপ সৃষ্টি হয়নি। অন্যদিকে অক্ষরেখা উপরে থাকায় এবং ঘূর্ণাবর্তের অভাবে নীচের দিকে কম নামায় সমুদ্রের উপর মৌসুমী অক্ষরেখার প্রান্ত শক্তিশালী হয়ে উত্তর পূর্ব , উত্তর বা পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগরে শক্তিশালী ঘূর্ণাবর্ত ও নিম্নচাপ তৈরি করেনি উল্লেখযোগ্য ভাবে। আর যেকটি নিম্নচাপ হয়েছে দুটি তা চলে গেছে ওড়িশার দিকে ।
বর্তমান বছরে বঙ্গোপসাগরের সক্রিয়তা:
⭐ নিরপেক্ষ থেকে ঋনাত্মক আই ও ডি:
বর্তমান বছরে আই ও ডি নিরপেক্ষ রয়েছে এবং ধীরে ধীরে ঋনাত্মকের দিকে যাবার সম্ভাবনা রয়েছে। নিরপেক্ষ আই ও ডির ক্ষেত্রে অস্ট্রেলিয়া উপকূল , ফিলিপাইন, ইন্দোনেশিয়া সুমাত্রার জলতাপমাত্রা ও মাদাগাস্কার ও পশ্চিম ভারত মহাসাগরে জলতাপমাত্রার মধ্যে সাম্যতা থাকে। ফলে সামগ্রিক ভাবে উত্তর ভারত মহাসাগরীয় অঞ্চল সক্রিয় থাকে মোটের উপর। অন্যদিকে ঋনাত্মক আই ও ডি এর ক্ষেত্রে পূর্ব ভারত মহাসাগর, প্রশান্ত মহাসাগর ও বঙ্গোপোসাগর অতি সক্রিয় থাকে। বর্তমান বছরে নিরপেক্ষ থেকে ঋনাত্মক আই ও ডি থাকবে ফলে বঙ্গোপোসাগরে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝার সম্ভাবনা রয়েছে এই বছর। এবং আগামী দিনে সেই ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝার বেশ কিছু পশ্চিমবঙ্গে প্রবেশ করতে পারে তা নিম্নচাপ, গভীর নিম্নচাপ বা ঘূর্ণিঝড় যাই হোকনা কেন।
⭐ উইক লা-নিনা :
উইক লা-নিনা হল নিরপেক্ষ ENSO এর একটি চরম অবস্থা যেখানে পূর্ব প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল শীতল ও পশ্চিম প্রশান্ত উষ্ণ হয়ে থাকে।
যার জন্য পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ও
সংলগ্ন বঙ্গোপোসাগর ও ভারত মহাসাগরে প্রচুর পরিমাণে পরিচলন এবং ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝার মাত্রা যথেষ্ট বেশি হয়ে থাকে। বর্তমান বছরে দুর্বল লা নিনার প্রভাবে বঙ্গোপোসাগর অতি সক্রিয় হয়ে উঠতে পারে আগামী দিনে।
⭐ SST : সমুদ্র জলতাপমাত্রা বর্তমানে বঙ্গোপোসাগর ও সংলগ্ন এলাকায় যথেষ্ট বেশি রয়েছে। সাধারণত ২৮-৩০° সে তাপমাত্রা বা তার উপর জলতাপমাত্রা সিস্টেমের জন্য অনুকূল। বর্তমানে সমুদ্র জলতাপমাত্রা বঙ্গোপোসাগরে ক্রান্তীয় ঝঞ্ঝা সৃষ্টি ও শক্তিশালী হয়ে ওঠার জন্য অনুকূল রয়েছে।
👉 সমগ্র উপরের প্যারামিটার গুলি বিচার করে ওয়েদার অফ ওয়েস্টবেঙ্গল জানায় নিরপেক্ষ থেকে ঋনাত্মক এল নিনো, ইন্ডিয়ান ওশেন ডাইপোল , উচ্চ সমুদ্র জলতাপমাত্রা থাকলেও উচ্চ উইণ্ড শেয়ার, এম জে ও এর স্থানান্তর ও বেশিরভাগ সময়ে অনুকূল এম জে ও না থাকা,
প্যাসিফিক ওশেনের উচ্চ উইণ্ড শেয়ার ও অনেকদিন উচ্চ্চাপের প্রভাবাধীন থাকা , মৌসুমী অক্ষরেখার বেশিরভাগ সময় উত্তরে গমনের জন্য ও আরো কিছু কারণের জন্য বঙ্গোপোসাগরে উল্লেখযোগ্য নিম্নচাপ বর্তমানে এবং বিগত দিনে গঠিত হতে পারেনি।
তবে বিগত বছরের ন্যায় এবছরেও ওয়েদার অফ ওয়েস্টবেঙ্গল জানায় আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গোপোসাগর আবার নতুন করে সক্রিয় হতে পারে। গত বছর আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে ওড়িশার উপকূলীয় এলাকায় আছড়ে পড়েছিল অতি গভীর নিম্নচাপ। তারপর থেকেই বর্ষা ক্রমশ সক্রিয় হয়ে উঠেছিল কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গে। এবছরেও আগষ্টের প্রথম সপ্তাহে বঙ্গোপোসাগরে একটি নিম্নচাপ সৃষ্টি হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আগামী দিনে বঙ্গোপসাগর সক্রিয় হতে পারে কারণ :
🛑 আগস্ট সেপ্টেম্বর মাসে বঙ্গোপোসাগর ও সংলগ্ন এলাকার উইণ্ড শেয়ার কমতে পারে।
🛑 বঙ্গোপসাগরে এম জে ও স্থিতি হতে পারে। সাধারণত ফেজ ২ থেকে ফেজ ৩ ও ৪ এ আসার সম্ভাবনা রয়েছে আগষ্ট সেপ্টেম্বর মাসে।
🛑 প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে আগষ্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে টাইফুনের সম্ভাবনা বাড়তে পারে।
🛑 বঙ্গোপসাগরে কনভেনশন ও প্রচুর পরিমাণে সুপ্ত লীনতাপ সুষ্পষ্ট নিম্নচাপ বা গভীর নিম্নচাপে পরিণত করতে পারে নিম্নচাপকে।
🛑 বঙ্গোপসাগরে উচ্চ সমুদ্র জলতাপমাত্রা ও পোটেনশিয়াল এনার্জি বৃদ্ধি পাওয়া।
🛑 নিরপেক্ষ এল নিনো ও ঋণাত্মকের দিকে আই ও ডি।
🛑 আগস্ট মাস থেকে মৌসুমী অক্ষরেখাটি দক্ষিণবঙ্গ হয়ে উত্তর পূর্ব ও পূর্ব মধ্য বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত থাকতে পারে বেশিরভাগ সময়।
লেখা ও বিশ্লেষণ: অর্ঘ্য বটব্যাল
তারিখ: ৩০.৭.২০
সময়: সকাল ৭ টা।
No comments:
Post a Comment