প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগের অন্যতম বিভীষিকাময়
ঘটনা হলো বজ্রপাত। মেঘের মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানের মিথস্ক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় বজ্রপাত। যা ভূপৃষ্ঠে সরাসরি নেমে এসে মানুষ সহ নানা সম্পদের ক্ষতিসাধন করে থাকে। বিগত দিনের তুলনায় বর্তমান সময়ে ভয়াবহ বজ্রপাতের পরিমাণ ক্রমাগত বাড়ছে। এবার দেখে নেওয়া যাক বজ্রপাত কিভাবে তৈরি হয়:-
পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি বজ্রপাত ঘটে থাকে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ থেকে। কিউমুলো শব্দের অর্থ হলো ঘন এবং গুণত্তর হারে উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া। এই মেঘ পরিচলন পক্রিয়ায় সৃষ্টি হয় এবং প্রচুর পরিমাণে জলধারন করে থাকে অর্থাৎ নিম্বাস বা বৃষ্টি ঘটাতে সক্ষম মেঘ। ধরা যাক অনুকূল পরিবেশে কিউমুলোনিম্বাস মেঘ তৈরি হচ্ছে ৫ মিনিটে মে উচ্চতা থাকবে ১০-১৫ মিনিটের মধ্যে উচ্চতা আরও বেশি হয়ে যায়। ৩০ মিনিটের মধ্যেই সর্বাধিক উচ্চতায় পৌঁছাতে পারে এই মেঘ। এবং একসময় বহু উচ্চতায় ওঠার জন্য একদিকে হেলে যেতে থাকে এবং একসময় এই মেঘ ভেঙে পড়ে। অর্থাৎ সর্বাধিক জলধারন করার পর এতটাই ভার হয়ে যায় দ্রুত হারে অধক্ষেপণ হতে থাকে। কিউমুলোনিম্বাস কত তাড়াতাড়ি সর্বাধিক উচ্চতায় উঠবে তা নির্ভর করে সোলার রেডিয়েশন মাত্রা, কেপসূচক, লিফটেড সূচক এবং উচ্চ পরিচলন হারের উপর। কিউমুলোনিম্বাস মেঘ নেহাই আকারের দেখতে হয়। এবং তুমুল বজ্রপাত, ঝড়বৃষ্টি, রেনস্টোর্ম , টর্নেডো হয়ে থাকে। বর্তমানে প্রাক মৌসুমী বৃষ্টিতে এই ধরণের মেঘ থেকে বৃষ্টি হয় তাই ঝড়বৃষ্টি ও বজ্রপাতের মাত্রা তীব্রতর হয়ে থাকে।
তাই চিত্রে দেখতে পাওয়া এই ধরনের মেঘ বর্তমান সময়ে তৈরি হলে সঙ্গে সঙ্গে খোলা স্থান ত্যাগ করুন। বৃক্ষ জাতীয় গাছের নীচে দাঁড়াবেন না। বাড়ির মধ্যে থাকুন। ধাতব বস্তুর সংস্পর্শে থাকবেন না। বাড়ির মধ্যে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় চার্জ দেবেন না ও চার্জে দেওয়া থাকলে আনপ্লাগ করুন। জলে নামবেন না। উঁচু যায়গায় উঠবেন না। কিউমুলোনিম্বাস মেঘ খুবই ভয়াবহ। মানুষের জীবনকে শেষ করে দিতে পারে এই ধরনের মেঘ থেকে তৈরি হওয়া ভয়াবহ বজ্রপাত। বৃক্ষজাতীয় গাছ , মোবাইল টাওয়ার, ট্রান্সফরমার ও নানা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার ক্ষতিসাধন করে।
পূর্ব বর্ধমান, ২৪ পরগণা, হুগলির বজ্রপাত: গত ৪৮ ঘন্টায় দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে ভয়াবহ বজ্রপাত লক্ষ করা গেছে। ২৪ পরগণা, হুগলি ও পূর্ব বর্ধমান জেলার উপর স্থবির প্রকৃতির কিউমুলোনিম্বাস মেঘ থেকে বৃষ্টি হওয়ার জন্য ভয়াবহ বজ্রপাত হয়েছে। মূল সুউচ্চ কিউমুলোনিম্বাস মেঘ ওই সমস্ত অঞ্চলের উপর ছিল। এছাড়া ওই সমস্ত অঞ্চলে সোলার রেডিয়েশন বেশি থাকায়, উইণ্ড শেয়ার ও বায়ুর চাপ পার্শ্ববর্তী অঞ্চলের তুলনায় কমে যাওয়ায় বজ্রগর্ভ মেঘ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ওই সমস্ত অঞ্চলের উপর শক্তিশালী হয় এবং ভয়াবহ বজ্রপাত সহ ঝড়বৃষ্টি ক্ষতিসাধন করে। কোথাও কোথাও আকস্মিক প্রবল ঝড় ও বৃষ্টি হয়। ৪৮-৭২ ঘন্টায় কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের নানা জায়গায় ভয়াবহ বজ্রপাত সহ ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে।
বজ্রপাত সৃষ্টিতত্ব: সাধারণত মেঘের মধ্যে ধনাত্মক ও ঋণাত্মক আধানের মিথস্ক্রিয়া ও পার্শ্ববর্তী পরিবেশের আধানের বৈচিত্র্য বজ্রপাত সৃষ্টির কারণ। মেঘের উপরিভাগে ধনাত্মক আধান ও নীচের দিকে ঋনাত্মক আধানের সমন্বয় ঘটে। এবার ভূূপৃৃষঠ সংলগ্ন এলাকায় ধনাত্মক আধান থাকলে ঋনাত্মক আধান ও ধনাত্মক আধানের মিথস্ক্রিয়ার জন্য ঋনাত্মক চার্জ সমন্বিত বজ্রবিদ্যুৎ মাটিতে নেমে আসে। এই ধরনের বিদ্য্যুতে শাখা থাকেনা বা খুব কম থাকে। অন্যদিকে মেঘের উপরের ধনাত্মক আধান থেকে যখন সারফেশ এ থাকা ঋনাত্মক আধানের বস্তুর আকর্ষণে যে বজ্র তৈরি হয় তাকে ধনাত্মক আধানের বজ্র বলা হয়ে থাকে। এই বজ্রপাতে শাখা বেশি থাকে। সাধারণত প্রবল বজ্রঝঞ্ঝার সময় ধনাত্মক আধানের বজ্র বিশেষত জলের উপর দেখা যায়। অন্যদিকে ঋনাত্মক আধানের বজ্র ভূূৃপৃষঠে থাকা গাছপালা, মানুষ ও ধনাত্মক আধানের বস্তুর উপর পড়ে। এই বজ্রপাত বেশি হয়ে থাকে আমাদের এখানে। ধনাত্মক আধান যুুকত বজ্রপাতকে + দিয়ে এবং ঋনাত্মক আধানের বজ্র্রকে - দিয়ে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে।
বজ্রপাতের শ্রেণীবিন্যাস:
বজ্রপাতের শ্রেণীবিন্যাস অনেক রকমের হয়ে থাকে। সেগুলো নীচে আলোচনা করা হলো।
ক্লাউড টু গ্রাউন্ড লাইটিং : সাধারণ এই ধরনের বজ্রপাত হলো সাক্ষাৎ মৃত্যুদূত। বর্তমান সময়ে এই ধরনের বজ্রপাত কেড়ে নিচ্ছে বহু প্রাণ। বিগত ৪৮ ঘন্টায় ব্যারাকপুর সহ উত্তর ২৪ পরগণা ও দ ২৪ পরগণা, হুগলি, বর্ধমান জেলায় এছাড়াও দক্ষিণবঙ্গের আরো বেশ কিছু যায়গায় এবং বাংলাদেশের বেশ কিছু যায়গায় এই ধরনের বজ্রপাত দেখা গেছে। ক্লাউড টু গ্রাউন্ড লাইটেনিং কে ওয়েদার অফ ওয়েস্টবেঙ্গল লাল বজ্রপাত নামক বিশেষ ক্যাটেগরিতে ভাগ করেছে। প্রতি মিনিটে মেঘ থেকে কোনো অঞ্চলে কতগুলি গ্রাউন্ড স্ট্রাইকিং হবে তার উপর ভিত্তি করে কোনো অঞ্চলকে লাল বজ্রপাত যুক্ত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। এই ক্লাউড টু গ্রাউন্ড স্ট্রাইককে CG strike বলা হয়। এই বজ্রপাত দুধরনের হয় যথা +Cg ও -Cg স্ট্রাইক। আগামী ৪৮-৭২ ঘন্টায় কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গ ও বাংলাদেশের বেশ কিছু যায়গায় এই ধরনের বজ্রপাত বেশি হবে তাই আগাম সতর্কতা নিয়ে রাখুন।
ক্লাউড টু এয়ার লাইটেনিং : এই ধরনের বজ্রপাত সাধারণত দেখা যায় মেঘপুঞ্জ থেকে বাতাসের মধ্যে। সাধারণত বায়ুমণ্ডলীয় স্তর পর্যন্ত পৌঁছালেও ভূপৃষ্ঠ পর্যন্ত নেমে আসে না ক্লাউড টু এয়ার লাইটেনিং। সাধারণত মেঘপুঞ্জের তড়িতাধান ও বায়ুমণ্ডলীয় স্তরে থাকা ধূলিকণার তড়িতাধানের মধ্যে সংযোগের প্রভাবে এই ধরনের বজ্রপাত দেখা যায়। এই লাইটেনিং কে বলা হয় CA strike.
ক্লাউড টু এয়ার লাইটেনিং : CA lightening
ক্লাউড টু ক্লাউড লাইটেনিং : এই ধরনের বজ্রপাত একটি মেঘ থেকে অপর মেঘে সঞ্চালিত হয়। ধরা যাক একটি মেঘের উপরিস্তরের + আধান ও নীচের স্তরের মেঘের - আধানের মধ্যে আসঞ্জনের প্রভাবে উপরিভাগের মেঘ থেকে নীচের স্তরের মেঘের মধ্যে বজ্রপাত নেমে আসে। একাধিক সূত্র বিশিষ্ট পাশাপাশি কিউমুলোনিম্বাস মেঘের সারি তৈরি হলে ধাপে ধাপে তখন ক্লাউড টু ক্লাউড লাইটেনিং দেখা যায়।
মূল তিনধরনের বজ্রপাত ছাড়াও রয়েছে গ্রাউন্ড টু ক্লাউড লাইটেনিং এখানে ভূপৃষ্ঠ ও মেঘের মধ্যে লাইটিং স্ট্রাইকের প্রতিক্রিয়া গড়ে ওঠে। এবং বিপরীত গামী ভার্টিক্যাল লাইটিং স্ট্রাইক দেখা যায়। এছাড়া রয়েছে ইনট্রাক্লাউড লাইটেনিং, সিট লাইটেনিং।
রঙের ভিত্তিতে বজ্রপাতের শ্রেণীভেদ :
বাতাসের জলীয়বাস্পের পরিমাণ এবং ডাস্ট পার্টিকেলের পরিমাণের উপর ভিত্তি করে নানা রকম বর্ণের বজ্রপাত দেখা যায়। সাধারণত বাতাসে জলীয় বাষ্পের পরিমাণ বেশি থাকলে এবং ধূলিকণার পরিমাণ কম থাকলে এই ধরনের বজ্রপাত দেখা যায়। সোলার রেডিয়েশন বেশি যেসম্ত অঞ্চলে হয়ে থাকে সেখানে এই ব্লু লাইটেনিং বেশি দেখা যায়। এই বজ্রপাত তীব্র শিলাবৃষ্টি, মাইক্রোব্রাস্ট, প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টির ইঙ্গিত দেয়। ব্লু লাইটেনিং এর পাশাপাশি পার্পেল লাইটেনিং এর ভূমিকা উল্লেখযোগ্য সাধারণ প্রচুর পরিমাণে বাতাসে ও মেঘে জল থাকলে এবং খুবই কম মাত্রার ধূলিকণা থাকলে এই ধরনের বজ্রপাত দেখা যায়। প্রাক মৌসুমী বৃষ্টির ক্ষেত্রে ব্লু লাইটেনিং ও পার্পেল লাইটেনিং পাশাপাশি সাদা বজ্রপাত বেশি দেখা যায়। খুব মারাত্মক বজ্রপাত হলো এই তিন ধরনের বজ্রপাত। এই তিন ধরনের বজ্রপাত একনাগাড়ে ভারী বৃষ্টি ও বজ্রমেঘ কোষ শক্তিশালী হওয়াকে ইঙ্গিত করে। সাধারণত বাতাসে জলীয় বাষ্পের তুলনায় ধূলিকণার পরিমাণ বেশি থাকলে ইয়লো লাইটিং দেখা যায়। এই সমস্ত মেঘ থেকে বৃষ্টির তীব্রতা কম থাকে। দমকা হাওয়া বেশি থাকে। গ্রীন লাইটেনিং মাঝে মধ্যে নিম্ন বায়ুমণ্ডলীয় স্তরের ভাসমান মেঘের সংঘর্ষে তৈরি হয়। এই লাইটেনিং এ আওয়াজ হয়না। তেমন কোনো ক্ষতিসাধন করে না। সাধারণত শক্তিশালী নিম্নচাপে আসা নীচু স্তরের ভাসমান দ্রুতগামী নিম্নস্তরের মেঘপুঞ্জে এই লাইটেনিং দেখা যায়।
রেড লাইটেনিং সাধারণত উচ্চ বায়ুমণ্ডলীয় স্তরে বজ্রঝঞ্ঝার মেঘ কোষের তড়িত বিচ্ছুরণের জন্য সৃষ্টি হয়। এটি দেখা যায় কিউমুলোনিম্বাস মেঘের উপরের স্তরে। উপরের স্তরে ধনাত্মক আধান থাকায় এবং নীচের স্তরের মেঘের ঋনাত্মক আধানের মধ্যে ধনাত্মক বজ্রপাত হতে থাকে। অন্যদিকে উপরের স্তরে প্রচুর পরিমাণে Electronic discharge এর কারণে লাল বজ্রপাত দেখা যায়। কমলা বজ্রপাত সাধারণত বিরল বজ্রপাত বাতাসে খুব কম জলীয় বাষ্প ও বেশি এরোসল থাকলে কমলা বজ্রপাত দেখা যায়।
এছাড়া বজ্রপাতকে আরো দুই ভাগে ভাগ করা যায় মা ক্লাউড টু ক্লাউড লাইটেনিং এর শ্রেণীভেদ যথা ইন্টার ক্লাউড ও ইনট্রা ক্লাউড লাইটেনিং। দুটি পাশাপাশি থাকা বজ্রমেঘের মধ্যে লাইটেনিং হলে তাকে বলা হয় ইন্টারক্লাউড লাইটিং এবং এক মেঘের উপরের স্তর ও নীচের স্তরের মেঘের বজ্রপাতকে বলা হয় ইনট্রাক্লাউড লাইটেনিং।
আগামী ৪৮-৭২ ঘন্টায় কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন যায়গায় বিক্ষিপ্ত ভাবে বজ্রবিদ্যুত সহ ঝড়বৃষ্টির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রবল বজ্রপাত দেখা যাবে কলকাতা সহ দক্ষিণবঙ্গ, উত্তরবঙ্গ ও বাংলাদেশে। তাই সতর্ক থাকুন। কোথাও কোথাও দমকা ঝোড়ো হাওয়া দেখা যাবে।।
#Classificationoflightening #Thunder #Cuni #Preqution#Tspossibility #Westbengal#Bangladesh.
Weather of Westbengal.
7.6.2021.
No comments:
Post a Comment